সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ । ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক

অনলাইন ডেস্ক »

নিউজটি শেয়ার করুন

১৯১১ সালে এ.কে. ফজলুল হক সমবায় বিভাগের অ্যাসিস্টান্ট রেজিস্ট্রার পদে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে রেজিস্ট্রারের পদ খালি হলেও ফজলুল হকের যোগ্যতার প্রতি অবিচার করে ব্রিটিশরা রায়বাহাদুর যামিনী কান্ত মিত্রকে সেই পদে বহাল করে। ফজলুল হক এই অন্যায় অবিচার সহ্য করার লোক ছিলেন না।

স্যার সলিমুল্লাহ ফজলুল হককে চাকরি ছেড়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন। খানবাহাদুর হাসেম আলী খানকে সঙ্গে করে হক সাহেব শ্রদ্ধেয় গুরু স্যার আশুতোষের সঙ্গে দেখা করতে কলকাতা এলেন। ফজলুল হককে দেখেই স্যার আশুতোষ বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোমাকে বারবার বলেছি চাকরি ছাড়তে, তবু তোমার গোলামির মোহ গেল না?” ফজলুল হক বললেন, “একসঙ্গেই মাসের শেষে মাইনের টাকাটা পাই….।” জবাব শুনে স্যার আশুতোষ বললেন, “তুমি দেরি না করে, হাইকোর্টে উকালতি শুরু করো, যতো দিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারো, আমি পকেট থেকে তোমাকে মাসে পাঁচ শ করে টাকা দেব।”

ফজলুল হক চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন। কিন্তু সরকার তা গ্রহণ না করে দীর্ঘদিনের ছুটি মঞ্জুর করল এবং ছুটি শেষে তাঁকে ডায়মন্ডহারবারের এসডিও করে হুকুমনামা পাঠিয়ে দিল। কিন্তু ফজলুল হক এই চাকরি গ্রহণ না করে ১৯১১ সালেই কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করে দিলেন এবং এক বছরের মধ্যেই হাইকোর্টের একজন সেরা উকিল বলে গণ্য হলেন।

ফজলুল হককে আর স্যার আশুতোষের অর্থসাহায্য নিতে হয় নি। ওকালতিতে এত দ্রুত উন্নতির নজির খুব কমই পাওয়া যায়। হক সাহেবকে অকুণ্ঠ স্নেহ, উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়েছিলেন স্যার আশুতোষ, মহাত্মা অশ্বিনীকুমার এবং স্যার সলিমুল্লাহ। এই তিন মহামানবের স্নেহ মমতা, সাহচর্য ও আশীর্বাদ লাভ করেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাংলার শার্দূল, অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক।

১৯১৭ সালে সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরাচারী ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন ভারতের সংবাদপত্রগুলোর কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্যে ‘ভারতীয় প্রেস অ্যাক্ট’ নামক একটি কুখ্যাত আইন পাস করে। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ৩২তম অধিবেশনে সাংবাদিক বি জি হর্নিম্যান এই কুখ্যাত আইনটি বাতিলের দাবিতে প্রস্তাব আনেন।

হর্নিম্যান সাহেব ছিলেন বোম্বাই ক্রনিক্যাল পত্রিকার সম্পাদক। শেরে বাংলা ফজলুল হক হর্নিম্যান সাহেবের এই প্রস্তাব সমর্থন করে উক্ত অধিবেশনে বজ্রকন্ঠে একটি গুরুগম্ভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ রেখেছিলেন। তিনি বলেন, “সম্মিলিত ভারতবর্ষের কোটি কোটি কন্ঠের বজ্র আওয়াজকে রুখতে পারে দুনিয়ার আজ পর্যন্ত তেমন কোন শক্তি জন্ম লাভ করেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

নির্যাতন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা মানুষের স্বভাব। আমি আশা করছি ব্রিটিশ শাসকবর্গ সময় থাকতে সাবধান হবেন এবং অবিলম্বে আইনের পুস্তক থেকে এই দমন মূলক প্রেস অ্যাক্ট অপসারিত করবেন।” ১৯১৮ সালে শেরে বাংলা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন।

১৯১৯ সালে শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন। এই আন্দোলনকে পদদলিত করার জন্য পাস করা হয় কুখ্যাত ‘রাওলাট অ্যাক্ট’। ১৯১৯ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি এই কুখ্যাত আইনের বিরুদ্ধে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন ভারতের আরো বহু সংগ্রামী জননেতা। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল, মুজিবর রহমান, জীবনকৃষ্ণ রায়, আবুল কাসেম প্রমুখ। এই বছরই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এ. কে. ফজলুল হক, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, পন্ডিত মতিলাল নেহরু এবং বদরুদ্দীন তায়েনমীকে নিয়ে গঠিত হয় একটি উচ্চপর্যয়ের তদন্ত কমিটি। শেরে বাংলা ফজলুল হক ছিলেন যে কোন রকমের অন্যায় অবিচার আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং যে কোন আন্দোলনের অগ্র নায়ক।

১৯৩০-৩১ সালে শেরেবাংলা লন্ডনে প্রথম গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দেন। কংগ্রেস এই বৈঠক বয়কট করে ফলে এই গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ ঘটে। তিনি কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই বৈঠকে যান এবং ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, “আমাদের ধমনীতে গোলামের রক্ত প্রবাহিত হয় না।” শেরে বাংলার এই একটিমাত্র বক্তব্য থেকেই সেদিন বোঝা গেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মূল কথা।

১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাট পঞ্চম জর্জের রজত জয়ন্তী। এই উপলক্ষে বাধ্যতামূলকভাবে উৎসব পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয় সারা ভারত জুড়ে। সকল ধর্মের মানুষদের সর্বত্র মসজিদ, মন্দির এবং গির্জায় সম্রাটের দীর্ঘায়ু কামনা করে প্রার্থনা অনুষ্ঠান করতে আদেশ করা হয়।

কিন্তু সেদিন সারা ভারতের মাত্র একটি মানুষই এই অন্যায় ও অবৈধ আদেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক এই আদেশের প্রতিবাদ জানিয়ে এক জনসভায় ঘোষণা করেন কোন মুসলিম তার মসজিদে কোনো বিধর্মীর জন্য প্রার্থনা করতে পারবেন না। শেরে বাংলার এই ডাকে সাড়া দিয়ে সারা ভারতের মুসলিমরা সেদিন একসঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং সারা ভারতবর্ষের কোনও মসজিদে ব্রিটিশ সম্রাটের জন্য প্রার্থনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়নি।

১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কলকাতায় হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনেরও প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন শেরে বাংলা। শুধু সমর্থন নয়, তিনি শ্রদ্ধানন্দ পার্কে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তৃতা করা কালীন এই মনুমেন্ট ভেঙে ফেলার আদেশ দেন। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনেও শেরে বাংলা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন।

শেরে বাংলা ছিলেন একজন সাহসী যোদ্ধা। তিনি অত্যাচারী ইংরেজদের বিরোধিতা করে নিপীড়িত বঞ্চিত বাঙালিদের নানা অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের জন্য আজীবন লড়াই করেছিলেন। নিজের জীবনের কখনো পরোয়া করেননি। জীবন বাজি রেখে তিনি দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রাম করে গেছেন আমাদের দেশের ও সকলের আর্থ সামাজিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির জন্য।

আপনার মন্তব্যটি লিখুন
শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »