বুধবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ । ২০ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কৃষি খাসজমি সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা: প্রেক্ষাপট সাতক্ষীরা

আবুল কালাম আজাদ »

নিউজটি শেয়ার করুন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে দেশে প্রথমবারের মতো ভূমিহীনদের মাঝে খাসজমি বিতরণের কার্যক্রম শুরু হয়। মাত্র সাড়ে তিন বছরে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩০ একর খাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। উক্ত জমিতে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩২৩টি ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। এত স্বল্প সময়ে এই বিপুল পরিমান খাসজমি বন্দোবস্ত দিয়ে ব্যাপক সংখ্যক ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসন পরবর্তীতে আর কোন সরকার করতে পারেনি।

শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুই ভূমিহীন, দুস্থ ও নদীভাঙন কবলিত মানুষদের পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে দেশে ‘গুচ্ছ গ্রাম’ প্রতিষ্ঠা করার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উদ্যোগের অংশ হিসেবে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চর ক্লার্ক এলাকায় চারটি গুচ্ছ গ্রাম, নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার দিয়ারা বালুয়ায় একটি গুচ্ছ গ্রাম, লক্ষ্মীপুরের উপজেলা রামগতির অন্তর্গত চর পোড়াগাছায় একটি গুচ্ছ গ্রাম এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চর দরবেশে একটি গুচ্ছ গ্রাম তৈরি করা হয়। গুচ্ছগ্রামগুলোতে ১ হাজার ৪৭০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর এই যুগান্তরকারী উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়েছিল ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ভূমি জিরাত (সীমাবদ্ধকরণ) আদেশ পি.ও. নং ৯৮ জারির মধ্যদিয়ে। এটি ছিল দরিদ্র ভূমিহীন মানুষের পক্ষে এক ঐতিহাসিক দলিল। যা তিনি একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করার মাত্র ৮ মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ১৫ আগস্ট প্রণয়ন করেন। বৃটিশ ভারত এবং পাকিস্তান শাসনামলে এদেশের ভূমিহীন কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা তিনি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন।

তিনি জানতেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের সার্বিক উন্নয়নের বিষয়টি কৃষকের উপর নির্ভরশীল। তাদের অবস্থার পরিবর্তন হলে দ্রুত গতিতে দেশ এগিয়ে যাবে, এগিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি। তাই তিনি দরিদ্র ভূমিহীন কৃষকের হতে জমি হস্তান্তরের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই আইনে জমির সর্বোচ্চ সিলিং ১০০বিঘা নির্ধারণ করা হয়। এরফলে ভূমিহীন কৃষকের হাতে জমি প্রদানের পথ সুগম হয়। আর জমির মালিকানা পেলে কৃষক স্বাধীন ভাবে সেই জমি ব্যবহার করবে এবং তাদের হাতে থাকবে উৎপাদনের স্বাধীনতা, অন্যদিকে ধনী দরিদ্রের ভারসাম্য নিশ্চিত হবে। সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য এটি অপরিহার্য ছিল। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নির্মম শাহাদত বরণের পর ভূমিহীনদের মাঝে খাসজসি বন্দোবস্ত কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে।

পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে সামরিক সরকার ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ জারি করে জমির সর্বোচ্চ সিলিং ১০০বিঘা থেকে কমিয়ে ৬০ বিঘা নির্ধারণ করে এবং ১৯৮৭ সালের ১ জুলাই ভূমিহীনদের মাঝে খাসজমি বন্টন কার্যক্রমের জন্য এক পরিপত্র জারি করে। এর মাধ্যমে ভূমিহীনদের মাঝে খাসজমি বন্টনের নীতিমালা ও পদ্ধতি ঘোষণা করা হয়, যা ভূমিহীনদের মাঝে খাসজমি বন্টনের আইনী ও পদ্ধতিগত পথ উন্মুক্ত করে। এ নীতিমালার আওতায় উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে ভূমি সংস্কার কমিটি গঠন ও কার্যাবলী; খাসজমি ও ভূমিহীন পরিবারের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান; খাসজমি চিহ্নিত ও উদ্ধারকরণ প্রক্রিয়া; ভূমিহীন বাছাই ও অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি ও খাসজমি বন্দোবস্তে কেস নথি তৈরি করার প্রক্রিয়াসমূহ বিস্তারিত বর্ণিত হয়। এ আইনের আওতায় গুচ্ছগ্রাম তৈরির বিধানও করা হয়।

এই নীতিমালার আওতায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভূমিহীনদের মধ্যে কৃষি খাসজমি বিতরণের কার্যক্রম সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু বিষয়টি ব্যাপক ও জটিল কার্যক্রম বিধায় সরকার ভূমিহীনদের মধ্যে কৃষি খাসজমি বন্টন কর্মসূচী অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সময়সীমা বৃদ্ধি করেন। তারপরও কৃষি খাসজমি বন্টনের ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি, জমি বন্টনের ফলে বন্দোবস্তযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাওয়া, জনসংখ্যা ক্রমবৃদ্ধির ফলে ভূমিহীনদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াসহ নানা প্রকার জটিলতার উদ্ভব হওয়ায় ১৯৯৬ সালের ১৩ আগস্ট সরকার এক আদেশের মাধ্যমে সাময়িক সময়ের জন্য ভূমিহীনদের মাঝে খাসজমি বন্টন স্থগিত করেন।

রবর্তীতে সময়ের বিবর্তনে এবং জনসাধারণের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ভূমিহীনদের মধ্যে কৃষি খাসজমি বন্টনের একটি সুষ্ঠু ও গণমুখি নীতিমালা প্রণয়ণের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে ১৯৯৭ সালের ১২ মে নতুন করে ‘কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা-১৯৯৭’ প্রণয়ন করা হয়।

কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য, এই আইনের যথার্থ প্রয়োগ আজও হয়নি। বিপুল পরিমান খাসজমি চিহ্নিত করে উদ্ধার হয়নি। তৈরি হয়নি ভূমিহীনদের অগ্রাধিকার তালিকা। এমনকি তালিকাভূক্ত নিষ্কন্টক খাসজমির বেশিরভাগই সরকার ও ভূমিহীনদের কারও দখলে নেই। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, আইনের সঠিক প্রয়োগ হতে হলে আইনের ফাঁক-ফোকরগুলো দূর করতে হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে আজ অবধি রাজনৈতিক বিবেচনায় আইনটির নানা সংশোধন করা হয়েছে; তবে তা কেবলমাত্র আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে বহুগুনে বাড়িয়েছে, প্রয়োগিক জটিলতাগুলো দূরীভূত হযনি। খাসজমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, নিয়মনীতি ও আইন-কানুনের দুর্বলতার চোরাগলিতে এদেশের ভূমিহীনতা ও দারিদ্র্য সমস্যাটি আজ অবধি ঘুরপাক খাচ্ছে।

বিদ্যমান আইন ও নীতির দুর্বলতা, ক্ষেত্র বিশেষে আইনের পরস্পর বিরোধী অবস্থানও খাসজমি হস্তান্তরে বাধা হয়ে আছে। বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী শুধুমাত্র কৃষি শ্রেণীর খাসজমিই বন্দোবস্ত দেয়া যায়, অকৃষি শ্রেণীর জমিতে ভূমিহীনের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়নি। আবার চিংড়িমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় চিংড়ি ঘের উপযোগী খাসজমি চিংড়ি ঘের মালিককে বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে দরিদ্র ভূমিহীনের পক্ষে ইজারা নেয়ার পথ বন্ধ করা হয়েছে। জলমহাল নীতিমালায়ও প্রকৃত ভূমিহীন মৎস্যজীবীর অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।

এছাড়া ভূমিহীনদের মাঝে খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়া হলেও দরিদ্র কৃষক যাতে জমিটি ধরে রাখতে পারে সে বিষয়টি এ আইনে বা নীতিমালায় বলা হলেও তা প্রয়োগে কোন কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি। আবার এ নীতিমালা সরকারি খাসজমি উদ্ধারে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারে না। ভূমিহীন চিহ্নিতকরণ ও তালিকাভূক্তির প্রক্রিয়াও স্বচ্ছ ও পরিপূর্ণ নয়। এছাড়া ভূমি বন্দোবস্তপ্রাপ্ত কৃষককে ব্যাংক বা সরকার কোন ধরণের সহযোগিতা বা ঋণ সহায়তা দেবে এমন কোন সুযোগ রাখা হয়নি। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বরাদ্দপ্রাপ্ত খাসজমির যথোপযুক্ত ব্যবহার করতে পারে না এবং জমি হস্তান্তরে বাধ্য হয়। ফলে ভূমিহীনতা চলতে থাকে। বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা অনুয়ায়ী ভূমি ব্যবস্থাপনায় সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয়ের অংশগ্রহণ থাকায় এক ধরণের সমন্বয়হীনতা ও জগাখিচুড়ি অবস্থাও বিদ্যমান।

উল্লেখিত নীতি ও আইনী দুর্বলতা ছাড়াও ’ভূমি মামলা’ আর এক জটিল, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া, যা জনজীবনে দুর্বিসহ অবস্থার সৃষ্টি করে। খাসজমি হোক বা নিজস্ব রেকর্ডিয় জমিই হোক, জমি সংক্রান্ত মামলা পরিচালনা করার সামর্থ্য গরীব ভূমিহীনদের নেই। কিন্তু পূর্ববর্তী সময়ে বিতরণকৃত খাসজমির একটা বড় অংশ কাগজে কলমে ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দিয়ে দখল হস্তান্তরের কথা বলা হলেও অনেকে এই জমি উদ্ধার করতে যেয়ে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে সর্বশান্ত হয়। এসব মামলা মোকদ্দমায় তাদেরকে আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়নি। এছাড়াও খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত পদ্ধতি জটিল ও দুর্নীতি করার সুযোগ থাকায় একজন ভূমিহীনকে খাসজমি পেতে দালাল, ইউনিয়ন ও উপজেলা ভূমি প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অদক্ষ ও আধা দক্ষ লোকজন দ্বারা ভূমি প্রশাসন পরিচালিত হওয়ায় এবং আইনের জটিলতা ও ভূমি প্রশাসনের কতিপয় অসাধূ কর্মকর্তা কর্তৃক খাসজমির তথ্য গোপন ও দুর্নীতির ফলে খাসজমির প্রকৃত তথ্য সাধারণের গোচরীভূত হয় না; যার ফলে ভূমিহীনরা খাসজমি সর্ম্পকে জানতেও পারেনা।

দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকার খাসজমি ও ভূমিহীনতার বহুবিধ কারণ:
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উজানের পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়া, পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাজার হাজার প্রকল্পের বিরূপ প্রভাব এবং কৃষি জমিতে লবণ পানি ঢুকিয়ে মাছ চাষের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় এক বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

আশির দশকের শুরুতে তৎকালীন খুলনা জেলা তথা সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় ধান চাষের জমিতে লবণ পানি ঢুকিয়ে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ শুরু হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে লক্ষ লক্ষ একর কৃষি জমি লবণাক্ত চিংড়ি ঘেরে পরিণত হয়। এসব চিংড়ি ঘেরে অন্তর্ভুক্ত হয় হাজার হাজার দরিদ্র প্রান্তিক কৃষকের কৃষি জমি। পর্যায়ক্রমে জবর দখল, জাল জালিয়াতি, মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ে এইসব দরিদ্র প্রান্তিক কৃষক জমির মালিকানা হারায়। ফলে দ্রুত বাড়তে থাকে ভূমিহীনের সংখ্যা। অপরদিকে কৃষিকাজের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক কম শ্রমিকের প্রয়োজন হয় চিংড়ি ঘেরে। এ কারনে কর্মসংস্থানের সুযোগও সংকুচিত হয়।

দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের জোয়ার-ভাটার নদ-নদীতে ষাটের দশক থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাজার হাজার প্রকল্প এবং চিংড়ি চাষের বিরূপ প্রভাবে এই অঞ্চলের ইকোলজিক্যাল সিস্টেম ভেঙে পড়ে। এর সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদী ভাঙন ও জলাবদ্ধতার সমস্যা যুক্ত হয়। ফলে কৃষি জমি ও ভিটা মাটি হারা মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পায়।

একই সময়ে জলমহাল নীতিমালার আওতায় চিংড়ি চাষযোগ্য এলাকার কৃষি খাস জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়। ফলে হাজার হাজার একর কৃষি খাস জমি চিংড়ি চাষের অকৃষি খাস জমিতে পরিণত হয়। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী চিংড়ি চাষের এই জমি ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বন্টনের কোন সুযোগ রাখা হয়নি। এজমি বন্টনের বিধান করা হয় চিংড়ি চাষিদের পক্ষে। যার কারণে এখানে ভূমিহীনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ার পাশাপাশি কৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত পাওয়ার সুযোগ কমে যায়।

একই কারণে জলাশয়, বিলের মধ্যের পানি নিষ্কাশনের খালসহ প্রাকৃতিক উপায়ে মাছ জন্মাতো এমন জমি চিংড়ি ঘেরের আওতায় চলে যায়। ফলে এসব জমিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো জেলে সম্প্রদায়ের এমন পরিবারগুলো বেকার হয়ে পড়ে। বর্তমান সময়ে বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ধরার উপর নানা ধরণের বিধি নিষেধের কারণে সুন্দরবনগামী হাজার হাজার জেলে পরিবারও সংকটের মুখে পড়েছে। এসব জেলে সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকাংশের বসবাস নদীর তীরবর্তী নিচু ভূমিতে। জলাবদ্ধতা ও নদী ভাঙনের শিকার হচ্ছে তারাই সবচেয়ে বেশি।

বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট:
গত ১৯ মে ২০২৩ বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে বসবাসরত ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ৯৮ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ধ্বংস হওয়ায় শহরে আসতে বাধ্য হয়েছে। এর প্রভাবে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। উপকূলীয় এলাকায় আর্থিক সক্ষমতার অভাবে অনেক পরিবারের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের প্রায় ২ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সমুদ্রের উচ্চবৃদ্ধির ফলে লবণাক্ত পানি উপকূলের আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করছে। এতে মিঠা পানির সংকট দেখা দিয়েছে। লবণাক্ত পানি পান করে এসব মানুষ দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে। দারিদ্র্য বাড়ছে।

কৃষি খাসজমি, ভূমিহীন সমস্যা এবং সাতক্ষীরার প্রেক্ষাপট:
আশির দশকে মাঝামাঝি সময়ে সাতক্ষীরা শহরতলীর ইসলামপুর চরের খাসজমিতে শহরে অবস্থানকারী ছিন্নমূল মানুষের পূনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন জেলা প্রশাসক। সেখানে প্রায় ২৬৭ পরিবারকে মৌখিকভাবে ঘরবাড়ি বেধে বসবাস করার সুযোগ দিয়ে পূনর্বাসন করেন তিনি। কিন্তু বিপত্তি বাধে পার্শ্ববর্তী প্রভাবশালী ঘের মালিকের ঐ জমিতে দৃষ্টি পড়ার পর। জমিতে বসবাসের অনুমতি প্রদানকারী জেলা প্রশাসকের বদলীর পর শুরু হয় বসবাসকারী ভূমিহীনদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া। তাদের উপর নেমে আসে সীমাহীন অত্যাচার নির্যাতনের খড়গ। একপর্যায়ে বসবাসকারী ভূমিহীনদের নেতার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে তার শিশু পুত্রকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় তীব্র গণআন্দোলন গড়ে উঠে।

পরবর্তীতে সাতক্ষীরার জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরকারি খাসজমিতে বন্দোবস্ত ছাড়াই বহু মানুষ খুপড়ি ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করে। কোথাও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মৌখিক অনুমতি নিয়ে, আবার কোথায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগীতায় এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। যেখানে বাধা আসে সেখানে গড়ে উঠে আন্দোলন-সংগ্রাম।

দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া শেষে সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা ও কালিগঞ্জ উপজেলার দুটি পরিবারের ৩ হাজার ১৭৮ একর জমি ১৯৮২ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোটের আ্যাপিলেট ডিভিশন ও হাইকোর্ট ডিভিশনের দুটি পৃথক মামলার রায়ে সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত করার আদেশ দেওয়া হয়। আদেশে উক্ত জমি অবৈধভাবে দখলে রাখার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় এবং সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী উক্ত জমি ভূমিহীন বন্দোবস্ত দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়। রায় অনুযায়ী উক্ত জমি ঐ বছরেই ভূমিহীনদের মাঝে একসনা ডিসিআর ও স্থায়ী বন্দোবস্তের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮৫ সালে সরকার উক্ত জমি চিংড়ি মহাল হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তীতে কখনো জলমহাল, কখনো বিশেষ জলমহাল, আবার কখনো চিংড়ি চাষযোগ্য বিশেষ জলমহাল নামে ঘোষণা করে ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত প্রদানের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ইজারার মাধ্যমে চিংড়ি চাষিদের মাঝে বন্দোবস্ত প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং ইজারা কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু এরই মধ্যে সহস্রাধীক ভূমিহীন পরিবার উক্ত জমি ডিসিআর পেয়ে সেখানে বসবাস শুরু করে। তাদের পক্ষ থেকে আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়। ফলে ১৯৯৩ সাল থেকে উক্ত জমি চিংড়ি চাষিদের ইজারা প্রদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৯৮ সালে মহামান্য হাইকোর্ট উক্ত জমির ইজারা টেন্ডারের উপর ইতোপূর্বে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করে এবং বসবাসকারী ভূমিহীনদের খাস জমি পাওয়ার জন্য যথাযথ আইন সম্মত পদক্ষেপ নিতে বলে। ভূমিহীনদের পক্ষে যথাযথ আইনী কার্যক্রম সম্পন্ন করে পুনরায় মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু সেই মামলার শুণানীর নির্ধারিত তারিখ ১৩ মে ১৯৯৮ এর পূর্বেই অতিদ্রুততার সাথে ইজারা প্রক্রিয়া শেষ করে ঐ বছর ১০ মে থেকে ইজারা গ্রহীতাদের মাঝে জমির দখল হস্তান্তর করতে বসবাসরত ভূমিহীনদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এই উচ্ছেদের বিরুদ্ধেই গড়ে উঠে ব্যাপক গণআন্দোলন। একপর্যায়ে ঐ বছর ২৭ জুলাই পুলিশ ও ইজারা গ্রহীতাদের সন্ত্রাসীদের হামলায় ভূমিহীন নেত্রী জায়েদা নিহত এবং কয়েক শত ভূমিহীন নারী পুরুষ শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। ঘটনার প্রতিবাদে ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার ভূমিহীন এলাকায় আসেন। তিনি উচ্ছেদ বন্ধের ঘোষণা এবং জমির শ্রণি পরিবর্তন করে সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী প্রকৃত ভূমিহীনদের মাঝে বন্দোবস্ত প্রদানের ঘোষণা দেন। তিনি গুলিতে নিহত ও গুরুতর আহত ভূমিহীনদের চিকিৎসা সহায়তাও প্রদান করেন।

জমি জাল জালিয়াতির সাতক্ষীরা স্টাইল:
সাতক্ষীরার দেবহাটা-কালিগঞ্জের দুটি পরিবারের ৩ হাজার ১৭৮ একর জমি ১৯৮২ সালে মহামান্য উচ্চ আদালতের রায়ে খাস হওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রভাবশালীরা জাল জালিয়াতির মাধ্যমে উক্ত জমির একাংশ দখল করে নেয়। ১৯৯৮ সালে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ পূর্ব ইজারা টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী জমির পরিমান উল্লেখ করা হয় ১ হাজার ৬৬০ একর। এর বাইরে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত দলিল হস্তান্তরের মাধ্যমে ৪৯৬ একর জমি ভূমিহীনদের মাঝে স্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়। অবশিষ্ঠ ১ হাজার ০২২ একর জমি জাল জালিয়াতি মামলা মোকদ্দামার মাধ্যমে প্রভাবশালীদের দখলে চলে যায়। এমন কি ১৯৯৮ সালে ইজারা টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল যে ১ হাজার ৬৬০ একর জমি তারও একাংশ জাল জালিয়াতির মাধ্যমে প্রভাবশালীদের দখলে চলে যায়। ফলে মামলা মোকদ্দমা থাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার পরও গত ২৫ বছরে দেবহাটা-কালিগঞ্জের সেই ৩ হাজার ১৭৮ একর খাস জমির দুই তৃতীয়াংশ এখনো ভূমিহীনদের মাঝে বন্দোবস্ত প্রদান প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে গেছে। কিন্তু একজন ভূমিহীনও খাসজমি দখলে নিয়ে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে জমির মালিক হয়েছে এমন কোন নজীর ঐ এলাকায় নেই। এমন কি সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকায় বৈধ আইনী প্রক্রিয়ার বাইরে খাম জমিতে বসবাসকারী হাজার হাজার ভূমিহীন পরিবারের কারো বিরুদ্ধে এক শতক জমিও জাল জালিয়াতি করে দখলে নেয়ার কোন অভিযোগ শোনা যায়নি।

সাতক্ষীরা জেলার ভূমিহীন ও খাসজমির বর্তমান চিত্র:
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে জেলায় কৃষি খাসজমির পরিমান ১৩ হাজার ২০৫ একর। পক্ষান্তরে অকৃষি খাসজমির পরিমান ১৯ হাজার ৯২৭ একর। এখানে চিংড়ি চাষের জমি হিসাবে কি পরিমান জমি ঘের মালিকদের বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ইজারা দেওয়া হয়েছে তার পরিমাণ জানা যায়নি। ১০ হাজার ৪৯৬ একর কৃষি খাসজমি বিভিন্ন সময়ে ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। মামলা মোকদ্দমা চলছে ২ হাজার ০৫৫ একর কৃষি খাসজমিতে। বর্তমানে বিতরণযোগ্য কৃষি খাস জমি রয়েছে মাত্র ২৮২ একর। এছাড়া অর্পিত সম্পত্তি, সড়ক বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের মালিকানাধীন কৃষি খাসজমির কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এমন কি এসব জমি কিভাবে কারা ব্যবহার করছে তারও কোন অফিসিয়াল তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে দুই শতক জমিসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘর পেয়েছেন সাতক্ষীরা জেলার ৩ হাজার ২২৭টি ভূমিহীন পরিবার। এরমধ্যদিয়ে সরকারী হিসাবে সাতক্ষীরা জেলার ৬টি উপজেলায় সনাক্তকৃত আর কোন ভূমিহীন নেই। শুধুমাত্র আশাশুনি উপজেলায় ২০১টি পরিবার রয়েছে পুনর্বাসনের অপেক্ষায়। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই সাতক্ষীরা জেলাকে ভূমিহীন মুক্ত ঘোষণা করা হতে পারে।

যদি সেটা হয়, তাহলে সেটা হবে একটা যুগান্তকারী ঘটনা। তবে অতীতের বাস্তবতা এর সমর্থক নয়। ১৯৮৭ সালের পর বিভিন্নস্থানে ব্যারাক নির্মাণ করে ভূমিহীনদের পুর্নবাসন করা হয়েছিল সেগুলোর অধিকাংশই বর্তমানে অস্তিত্বহীন হতে চলেছে। কিছুস্থানে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ বসবাস করলেও অন্যরা ব্যারাক ছেড়ে চলে গেছে। ফলে অস্তিত্ব রয়েছে এমন ব্যারাকগুলোর অধিকাংশ ঘরে কেউ বসবাস করে না।

অতিসম্প্রতি সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিষখালী ইউনিয়ানের দুধলীচর আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। গত ৩১ আগস্ট ২০২৩ তারিখে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক উক্ত প্রকল্প পরিদর্শন করেন। সরেজমিনে তিনি দেখতে পান ৪৬টি ঘরের মধ্যে মাত্র ১৫টি ঘরে দলিল পেয়ে বৈধভাবে ১৫টি পরিবার বসবাস করছেন। ১০টি ঘরে অবৈধভাবে লোকজন বসাবস করেন। কিন্তু তাদের নামে কোন দলিল নেই। এসব ঘরের বৈধ মালিকরা অন্যত্র বসাবস করেন। আর বাকী ২১টি ঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় ফাঁকা পড়ে আছে। ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে স্থানীয় পত্রিকায় এসংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

খাস জমি পেয়ে ভূমিহীনদের পরিবর্তনের হাওয়া:
১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর সাতক্ষীরার দেবহাটা ও কালিগঞ্জ উপজেলার ৯টি বিশেষ জলমহালের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে সহস্রাধীক ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। এই বন্দোবস্ত তালিকা অনুযায়ী ২০০৪ সাল হতে ২০০৬ সালের মধ্যে কালিগঞ্জ উপজেলার ভাঙানমারী গ্রামে প্রায় ২১০টি পরিবার খাস জমির দলিল পেয়েছে। দলিল পাওয়ার পূর্বে বসবাসকারী উক্ত ভূমিহীনদের অধিকাংশেরই ছিল দু’চালা খুপড়ি ঘর এবং কিছু পরিবারের চারচালা মাটির ঘর। একটিও পাকা আধাপাকা বাড়ি ছিল না। কিন্তু প্রত্যেকে সর্বোচ্চ এক একর করে জমি পাওয়ার পর তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ৮/১০ শতক জমি ভিটাবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করে তাতে গাছ-গাছালি ও শাক সজ্বির চাষ করতে থাকে। অবশিষ্ট জমিতে চাষবাদ করে। এরজন্য তাদের কোন অতিরিক্ত শ্রমিক মজুরের প্রয়োজন হয়নি। স্বামী-স্ত্রী সন্তানাদি সকলে একযোগে কাজ করেছে ঐ জমিতে। ফলে ভাগ্যের চাকা ঘুরতে সময় লাগেনি।

বর্তমানে ঐ ২১০টি পরিবারের ৫৩টি পরিবার সম্পূর্ণ ছাদযুক্ত পাকা বাড়িতে বসবাস করছে। ১৩টি পরিবার বসবাস করছে মাটির কাচা ঘরে। অবশিষ্ট সকল পরিবার পাকা দেওয়ালসহ এ্যাডবেস্টার অথবা টিনের ছাউনিযুক্ত বাড়িতে বসবাস করছে। অনেকে বাড়িতে টাইলস লাগিয়েছে। ৪৯টি পরিবারের ব্যবহারের জন্য নিজস্ব মোটর সাইকেল রয়েছে। অনেকে পাশের বিলে নতুন করে জমি কিনেছে। প্রায় প্রত্যেকের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়ছে। কমপক্ষে ১১জন পড়ছে কলেজে। সরকারী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, ব্যাংকার, কৃষি অফিসার হিসেবে সরকারী চাকুরী করছেন কমপক্ষে চারটি পরিবারের সন্তান। জমি বিক্রি করে চলে গেছে এমন লোক পাওয়া গেছে ৩জন। তাদের একজন পিতার ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে জমি বিক্রয় করতে বাধ্য হন। অপর দু’জন জালিয়াতির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী অন্য গ্রামে জমি নিয়ে এই গ্রামে পাওয়া জমি বিক্রয় করেছেন। এটি কোন জরিপের রিপোর্ট নয়। বরং এলাকার মুরুব্বিদের কাছে খোঁজ খবর নেওয়ার সময় তারা ২১০জনের তালিকা এনে সেখানে টিক মেরে কার কি হয়েছে তার একটি প্রাথমিক বর্ণনা দিয়েছেন মাত্র। তবে তারা নতুন করে কে কত সম্পত্তির মালিক হয়েছে তার বর্ণনা দিতে চাননি। ভাঙানমারীর সেই এক সময়ের ভূমিহীনদের গড় পাততার এই গল্প শোনার সময় পার্শ¦বর্তী আর জনপদ জায়েদানগরের এক ভূমিহীন বললেন তার ছেলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, ছেলে বিয়ে দিয়েছেন অপর এক ইঞ্জিনিয়ার মেয়ের সাথে। দু’জনাই এখন খুলনা শহরে চাকরি করেন। অপর একজন বললেন তার ছেলে মাস্টার্স ডিগ্রি পাশ করে এখন চাকরি খুঁজছে। এ ধরণের হাজারো সফলতার গল্প লুকিয়ে রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী খাস জমির মালিক হওয়া অসংখ্য পরিবারের।

আবার উক্ত জমি ভূমিহীনরা দখলে নেওয়ার পূর্বে সেখানে একর প্রতি যে পরিমান উৎপাদন হয়েছে বর্তমান উৎপাদন তার চেয়ে বহুগুন বেশি। কারন এখানে ভূমিহীনরা জমির মালিকানা পাওয়ার পর তারা এই জমিকে তাদের সন্তানের মতো গুরুত্ব দিয়েছে। পরিবারের সদস্যরা সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে সেখানে সোনালী ফসল ফলিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে এক ইঞ্চি জমি ফেলে না রাখার যে ঘোষণা দিয়েছেন ভূমিহীনরা তা বাস্তবায়ন করেছে আরো অনেক পূর্বে। একারনেই তাদের এই দ্রুত পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তন দেশের সামগ্রীক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিমূর্তভাবে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে চলেছে।

ভূমিহীনদের মাঝে খাসজমি বিতরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি:
দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্নমুখী কার্যক্রম চালু করেছে এবং এই খাতে জাতীয় বাজেটে প্রতিবছরই বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এই বরাদ্দ দারিদ্র পরিস্থিতির উত্তরণে যতটুকু না ভূমিকা রাখছে তার চেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষকে কর্মবিমুখ করছে এমন অভিযোগ এখন বিভিন্ন মহল থেকে আলোচিত হয়। এখন ধান কাটার মৌসুমে অনেক এলাকায় কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। এটাকে ইতিবাচক হিসেবে যেমন দেখানো যায়, আবার প্রকৃত দারিদ্র পরিস্থিতি নিরসনে যদি আশানুরূপ অগ্রগতি না হয় তাহলে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে। দেশে ধনী গরীব বৈষম্য বাড়ছে। আবার দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনসহ মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা পরিসংখ্যানের ব্যারোমিটারে সঠিকভাবে ধরা পড়ছে না।

সামগ্রীক প্রেক্ষাপটে ভূমিহীনদের কৃষি জমি প্রদানসহ তাদের হাতে সম্পদ বিতরণের বিষয়টি সামাজিক নিারপত্তা কর্মসূচির পাশাপাশি জোরদার করতে পারলে দারিদ্র পরিস্থিতির অতিদ্রুত উন্নয়ন সম্ভব। সেজন্য সরকারের দখলের বাইরে থাকা কৃষি-অকৃষি সকল খাসজমি উদ্ধার করতে হবে। যে সব খাসজমি চিহ্নিত হয়নি সেগুলো চিহ্নিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাল জালিয়াতির কারণে যেসব খাস জমি ইতোমধ্যে সরকারের বেহাত হয়েছে সেগুলো উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইনগত ও অন্যান্য পদক্ষেপ নিতে হবে। চাষযোগ্য সকল কৃষি ও চিংড়ি চাষের অকৃষি খাসজমি কেবলমাত্র ভূমিহীন কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়ভুক্ত মৎস্যজীবীদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। একই সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে এই এলাকা থেকে ব্যাপকহারে অভিবাসন বন্ধ করতে হবে। সেজন্য ভূমিহীন এবং জেলে সম্প্রদায়ভুক্ত মৎস্যজীবীদের জমি ছাড়াও সহায়ক অন্যান্য উপকরণ দিতে হবে। এখানকার দারিদ্র্য পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র অনুযায়ী জরুরিভাবে এসব পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক পত্রদূত, সাতক্ষীরা

আপনার মন্তব্যটি লিখুন
শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »